দিনে হোটেলে কাজ করতাম, রাতে করতাম অভিনয়

নায়ক নন, তিনি অভিনেতা। বলিউডে এখন অনেক খান কিংবা কাপুরদের চেয়ে পঙ্কজ ত্রিপাঠির কদর বেশি। চলচ্চিত্র,ওয়েব সিরিজে তিনি যেন অপরিহার্য হয়ে উঠেছেন। পেয়েছেন ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে বিশেষ সম্মাননাসহ আরও অনেক স্বীকৃতি। ২০১৯ সালে ‘গোয়া ফেস্ট’-এর ‘নলেজ সেমিনার’ নামের আয়োজনে তিনি ছিলেন বক্তা। সেই অনুষ্ঠানের নির্বাচিত অংশ নিয়ে এই প্রতিবেদন।

স্বপ্ন ছিল একটি ট্রাক্টর ঘরে এলে পড়ালেখা শেষ করে খেতখামারে কাজ করব। কিন্তু সেই ট্রাক্টরটি আমার বাবা কিনতে পারেননি। অত পয়সা আমাদের ছিল না। ট্রাক্টর যদি ঘরে এসে পড়ত, তাহলে হয়তো আজ আর আমার অভিনেতা হওয়া হতো না। আমি হয়তো গ্রামে থেকে মন দিয়ে খেতখামারেই কাজ করতাম।তাই জীবনে কোনো চাওয়া পূরণ না হলে শুরুতে একটু আক্ষেপ কাজ করে। কিন্তু একটা সময় আমাদের ঠিকই উপলব্ধি

হয়, যা হয়নি তা ভালোর জন্যই হয়নি। নাগার্জুন নামে বিহারের এক কবি বলেছেন, ‘যে কাজটি হয়নি পূরণ, তাকে আমি করি প্রণাম।’ জীবনে অনেক কাজই আমরা নানা কারণে পুরো করতে পারি না। আমার বাবাও ট্রাক্টরটি আর্থিক কারণে কিনতে পারেননি। তখন এ নিয়ে মন খুব খারাপ হয়েছিল। এখন মনে হয়, ভালোই হয়েছে। ট্রাক্টর কিনতে না

পারায় বাবা উপায়ন্তর না দেখে আমাকে বলেছিলেন, ‘তুমি বরং পড়ালেখাটাই মন দিয়ে করো। ডাক্তার হও। নিজে কামাই করে ট্রাক্টর কিনে নিজের স্বপ্ন পূরণ করো।’ বাবার এ কথাতেই ‘ডক্টর’ হওয়ার জন্য গ্রাম থেকে পাটনা শহরে আসি। কিন্তু ‘ডক্টর’ তো হতে পারিনি, হয়ে গেলাম ‘অ্যাক্টর’।অভিনেতা হওয়ার স্বপ্ন যখন চেপে ধরল আমাকে, দুই বছর স্নাতক করে পড়াশোনা ছেড়ে দিলাম। থিয়েটারে যোগ দেব

বলে হোটেল ম্যানেজমেন্টের কোর্স করে পাটনার একটি হোটেলে বাবুর্চির সহকারী হিসেবে চাকরি নিলাম। দিনের বেলা হোটেলের কিচেনে কাজ করতাম, রাতে করতাম থিয়েটার। কখনো কখনো আবার রাত ১১টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত রান্নাঘর পরিষ্কারের ডিউটিও করতাম, যেন দিনের বেলা থিয়েটারের কাজ করতে পারি। কিন্তু হোটেলের মানবসম্পদ

ব্যবস্থাপক খুব বকাঝকা করতেন। কখনো বলতেন, ‘তোমার ডিউটিতে মন নেই!’, ‘তোমাকে দিয়ে হবে না’ ইত্যাদি।একসময় মনে হলো, ‘নাহ্, এভাবে হবে না। আমি পুরোপুরি অভিনয়টাই করতে চাই।’ তাই তখন ড্রামা স্কুলে খোঁজ নিতে শুরু করলাম। জানলাম, ড্রামা স্কুলে ভর্তির ন্যূনতম যোগ্যতা হলো স্নাতক। কিন্তু আমি তো পড়াশোনা ছেড়ে

দিয়েছিলাম। হোটেল ম্যানেজমেন্টের যেই কোর্সটা করেছিলাম, সেটা স্নাতক মানের ছিল না। তাই অভিনয় করার ঝোঁকে আমি আবার পড়াশোনা শুরু করি। গ্র্যাজুয়েশন করতে তিন বছর লেগে যায়। এরপর ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামায়(এনএসডি) ভর্তি পরীক্ষা দিই। কিন্তু পরপর দুই বছর আমি সেখান থেকে প্রত্যাখ্যাত হই। আরও দুই বছর এভাবে কাটার পর তৃতীয় বছরে এনএসডিতে আমি ভর্তির সুযোগ পাই। এভাবেই অভিনেতা হওয়ার স্বপ্নপূরণের দিকে এগোতে থাকি।

বিজ্ঞাপনচিত্রে অভিনয়ের জন্য আমি বহু অডিশন দিয়েছি। ওখানে অফিসের বাইরে শ খানেক শিল্পী দাঁড়িয়ে থাকত নিজের ছবি নিয়ে। কাস্টিং ডিরেক্টর দরজা খুলে দাঁড়িয়ে হয়তো এক বা দুজনকে ডেকে নিত, বাকিদের বলে দিত ‘নট ফিট’ (উপযুক্ত নও)। আমি এত এতবার এই ‘নট ফিট’ কথাটা শুনেছি যে একসময় বাড়ি ফিরতে ভয় লাগত। বাড়ি গেলে বুঝি স্ত্রীও দরজা খুলে বলে দেবে ‘নট ফিট’।

আমি জানি না, কোন সেই শক্তির কারণে আমি ‘রিজেক্ট’ হওয়ার পরেও হাল ছাড়িনি। এটা মনে হয় আমাদের বেড়ে ওঠার কারণে, যে পরিস্থিতিতে বড় হয়েছি, সে কারণে হতে পারে। ওই যে ট্রাক্টর কিনতে না পারার ব্যর্থতা বা এ রকম

নানা রকমের সামর্থ্যহীনতা আমাদের মতো গ্রামের মানুষদের সহজে হার মানতে দেয় না। আমরা অনেক কঠিন থেকে কঠিন পরিস্থিতিতেও অবিচল থাকি, মনোবল শক্ত রাখি, আর ভাবি, কোনো না কোনোভাবে সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার বাড়ি থেকে আমাকে সাত কিলোমিটার পথ হেঁটে পাটনার ট্রেন ধরার জন্য স্টেশনে যেতে হতো। ওই পরিস্থিতিতে সাত

কিলোমিটার রাস্তা হেঁটে পার করা কোনো পরিশ্রমই মনে হতো না। কারণ, ওই সময় আমার কাছে হাঁটা ছাড়া তো কোনো বিকল্প ছিল না। মনোবল আর পরিশ্রমই ছিল একমাত্র সম্বল। অভিনেতা হওয়ার জন্য আমার কাছে এটা ছাড়া আর কোনো পথ ছিল না। ভাবতাম, একজন মানুষকে কতবার আর প্রত্যাখ্যান করা যায়? একবার না একবার তো আমার চেষ্টা আর অধ্যবসায় (প্যাশন) তারা দেখবেই।

বলিউডে অভিনয়ের জন্য আসার সময়ও আমার এটাই মনে হয়েছে—কয়বার কয়জন আমাকে প্রত্যাখ্যান করবে? করলে করুক। আমি চেষ্টা থামাব না। হার মানব না। আমি সব প্রোডাকশনের অফিসে আমার ছবি নিয়ে যেতাম। তখন ই–মেইলের যুগ ছিল না। ছবি প্রিন্ট করে নিয়ে যেতে হতো। অনেক অফিসে আমার ছবি দেখতই না, অনেক জায়গায় তো ঢুকতেই দিত না। কিন্তু আমার কথা হলো প্রত্যাখ্যানই তো করবে আমাকে, পুলিশে তো আর ধরিয়ে দেবে না।

লোকে বলে না, ‘এই প্রোডিউসার ওকে সিনেমায় ব্রেক (সুযোগ) দিয়েছে।’ আর আমাকে অসংখ্য মানুষ তাদের অফিসে ঢোকার আগে ‘ব্রেক করিয়ে’ (থামিয়ে) দিয়েছে। জীবনে এমন এত এত ‘ব্রেক’ পেতে হয়েছে, যে অভ্যাস হয়ে গেছে। কোনো পরীক্ষাই এখন আর কঠিন লাগে না। বিজ্ঞাপনচিত্রে অভিনয়ের জন্য আমি বহু অডিশন দিয়েছি। ওখানে অফিসের বাইরে শ খানেক শিল্পী দাঁড়িয়ে থাকত নিজের ছবি নিয়ে। কাস্টিং ডিরেক্টর দরজা খুলে দাঁড়িয়ে হয়তো এক বা দুজনকে ডেকে নিত, বাকিদের বলে দিত ‘নট ফিট’ (উপযুক্ত নও)। আমি এত এতবার এই ‘নট ফিট’ কথাটা শুনেছি যে একসময় বাড়ি ফিরতে ভয় লাগত। বাড়ি গেলে বুঝি স্ত্রীও দরজা খুলে বলে দেবে ‘নট ফিট’।

আসল কথা হলো, আমি আপাদমস্তক গ্রামের ছেলে। বিহারের পাটনার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে এসেছি। আমার গ্রাম থেকে পাটনা শহরের দূরত্ব ১৫০ কিলোমিটার। আমাদের ওদিকে ভালো পাকা রাস্তা ছিল না, গাড়ি চলত না, কোনো সুযোগ-সুবিধা আমরা পেতাম না। মনে আছে, আমরা ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা বাসে করে ভাঙা-খোঁড়া রাস্তা দিয়ে শহরে যেতাম। বিশ্বাস করুন—পড়ার জন্য, অভিনয়ের জন্য, স্বপ্নপূরণের জন্য যে ওই রাস্তা দিয়ে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা পথ পাড়ি দিতে পারে, তার কাছে যেকোনো প্রত্যাখ্যান বা ব্যর্থতাই গুরুত্বহীন।

যেই আমি একসময় হয়তো দুই বছরে দু–একবার ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে পারতাম, সেই আমি আজ বলিউডে কাজকর্ম করে জীবিকা চালিয়ে যাচ্ছি। একটা সময় ছিল, যখন টেলিভিশন প্রডাকশনের জন্য সহকারী শিল্পী হিসেবে সবাই শুধু আমাকে ছোটখাটো পুলিশের চরিত্র দিত। আমি সেটাও অনেক মন দিয়ে, যত্ন নিয়ে করতাম। একসময় তো ওই পুলিশের চরিত্রেরই এত প্রস্তাব আসা শুরু করল,

ভাবলাম, একটি পুলিশের ইউনিফরম বানিয়ে নিই। লোকে ডাকামাত্র ওই ইউনিফরম নিয়ে চলে যাব। কেউ তো একজন কখনো বলবে, ‘আচ্ছা, বাদ দাও। আজ অন্য কিছু করো।’ আমি অপেক্ষায় থাকতাম, আর প্রচণ্ড একাগ্রতার সঙ্গে কাজ করে যেতাম। একসময় তা-ই হলো। আমার একাগ্রতা হয়তো অনুরাগ কাশ্যপের চোখে পড়েছিল। আমাকে সে গ্যাংস অব ওয়াসিপুরের চরিত্রটি দিল। এরপর থেকে তো সবাই সব দেখেছে।